Responsive Ads Here

যমযম কুপের বিস্ময়কর ইতিহাস: এবং আব্দুল মুত্তালিব কতৃক পুনঃরুদ্ধারের বিস্ময়কর কাহিনী

যমযম কুপের বিস্ময়কর ইতিহাস: যেটা অনেকেরই অজানা ইবনু ‘ আব্বাস (রাঃ) বলেন , নারী জাতি সর্বপ্রথম কোমরবন্দ বানানো শিখ...

যমযম কুপের বিস্ময়কর ইতিহাস: যেটা অনেকেরই অজানা



ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নারী জাতি সর্বপ্রথম কোমরবন্দ বানানো শিখেছে ইসমাঈল (আঃ)-এর মায়ের নিকট থেকে

হাযেরা (আঃ) কোমরবন্দ লাগাতেন সারাহ (আঃ) থেকে নিজের মর্যাদা গোপন রাখার জন্য
অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) হাযেরা (আঃ) এবং তাঁর শিশু ছেলে ইসমাঈল (আঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন এ অবস্থায় যে, হাযেরা (আঃ) শিশুকে দুধ পান করাতেন

অবশেষে যেখানে কাবার ঘর অবস্থিত, ইবরাহীম (আঃ) তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মসজিদের উঁচু অংশে যমযম কূপের উপরে অবস্থিত একটা বিরাট গাছের নীচে তাদেরকে রাখলেন

তখন মক্কায় না ছিল কোন মানুষ, না ছিল কোনরূপ পানির ব্যবস্থাপরে তিনি তাদেরকে সেখানেই রেখে গেলেন

আর এছাড়া তিনি তাদের নিকট রেখে গেলেন একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর আর একটি মশকে কিছু পরিমাণ পানিঅতঃপর ইবরাহীম (আঃ) ফিরে চললেন

তখন ইসমাঈল (আঃ)-এর মা পিছু পিছু আসলেন এবং বলতে লাগলেন, হে ইবরাহীম! আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাদের এমন এক ময়দানে রেখে যাচ্ছেন, যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী আর না আছে কোন ব্যবস্থাতিনি এ কথা তাকে বারবার বললেনকিন্তু ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দিকে তাকালেন না

তখন হাযেরা (আঃ) তাঁকে বললেন, এর আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁহাযেরা (আঃ) বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না

অতঃপর তিনি ফিরে আসলেনআর ইবরাহীম (আঃ) -ও সামনে চললেনচলতে চলতে যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে পৌছলেন, যেখানে স্ত্রী ও সন্তান তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছে না, তখন তিনি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন

অতঃপর তিনি দুহাত তুলে এ দুআ করলেন, আর বললেন, “হে আমার প্রতিপালক! আমি আমার পরিবারের কতককে আপনার সম্মানিত ঘরের নিকট এক অনুর্বর উপত্যকায় রেখে যাচ্ছি.... যাতে আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে- (ইবরাহীম ৩৭)

আর ঈসমাঈলের মা ঈসমাইলকে স্বীয় স্তন্যের দুধ পান করাতেন এবং নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেনঅবশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেলতিনি নিজে তৃষ্ণার্ত হলেন এবং তাঁর শিশু পুত্রটিও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লতিনি শিশুটির দিকে দেখতে লাগলেনতৃষ্ণায় তার বুক ধড়ফড় করছে অথবা রাবী বলেন, সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে

শিশু পুত্রের এ করুণ অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয় হয়ে পড়ায় তিনি সরে গেলেন আর তাঁর অবস্থানের নিকটবর্তী পর্বত সাফা’-কে একমাত্র তাঁর নিকটতম পর্বত হিসাবে পেলেন

অতঃপর তিনি তার উপর উঠে দাঁড়ালেন এবং ময়দানের দিকে তাকালেনএদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথায়ও কাউকে দেখা যায় কিনা? কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না

তখন সাফাপর্বত থেকে নেমে পড়লেনএমন কি যখন তিনি নিচু ময়দান পর্যন্ত পৌছলেন, তখন তিনি তাঁর কামিজের এক প্রান্ত তুলে ধরে একজন ক্লান্ত-শ্রান্ত মানুষের মত ছুটে চললেন

অবশেষে ময়দান অতিক্রম করে মারওয়াপাহাড়ের নিকট এসে তার উপর উঠে দাঁড়ালেনঅতঃপর এদিকে সেদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পান কিনা? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন নাএমনিভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, এজন্যই মানুষ এ পর্বতদ্বয়ের মধ্যে সায়ী করে থাকে

অতঃপর তিনি যখন মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং তিনি নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা করতিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেনতখন তিনি বললেন, তুমি তো তোমার শব্দ শুনিয়েছযদি তোমার নিকট কোন সাহায্যকারী থাকে
হঠাৎ যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত সেখানে তিনি একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেনসেই ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন বা তিনি আপন ডানা দ্বারা আঘাত করলেনফলে পানি বের হতে লাগল

তখন হাযেরা (আঃ)-এর চারপাশে নিজ হাতে বাঁধ দিয়ে এক হাউজের মত করে দিলেন এবং হাতের কোষভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেনতখনো পানি উপচে উঠছিল

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ইসমাঈলের মাকে আল্লাহ রহম করুনযদি তিনি বাঁধ না দিয়ে যমযমকে এভাবে ছেড়ে দিতেন,কিংবা যদি কোষে ভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহলে যমযম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবাহমান ঝর্ণায় পরিণত হতোরাবী বলেন, অতঃপর হাযেরা (আঃ) পানি পান করলেন, আর শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন, তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোন আশংকা করবেন নাকেননা এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে

এ শিশুটি এবং তাঁর পিতা দুজনে মিলে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না
ঐ সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি যমীন থেকে টিলার মত উঁচু ছিলবন্যা আসার ফলে তার ডানে বামে ভেঙ্গে যাচ্ছিল

অতঃপর হাযেরা (আঃ) এভাবেই দিন যাপন করছিলেনঅবশেষে জুরহুম গোত্রের একদল লোক তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিলঅথবা রাবী বলেন, জুরহুম পরিবারের কিছু লোক কাদা নামক উঁচু ভূমির পথ ধরে এদিকে আসছিল
তারা মক্কায় নীচু ভূমিতে অবতরণ করল এবং তারা দেখতে পেল একঝাঁক পাখি চক্রাকারে উড়ছেতখন তারা বলল, নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপর উড়ছেআমরা এ ময়দানের পথ ধরে বহুবার অতিক্রম করেছিকিন্তু এখানে কোন পানি ছিল না
তখন তারা একজন কি দুজন লোক সেখানে পাঠালোতারা সেখানে গিয়েই পানি দেখতে পেলতারা সেখান থেকে ফিরে এসে সকলকে পানির সংবাদ দিলসংবাদ শুনে সবাই সেদিকে অগ্রসর হল

ইসমাঈল (‘আঃ)-এর মা পানির নিকট ছিলেনতারা তাঁকে বলল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাইআপনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি? তিনি জবাব দিলেন হ্যাঁতবে, এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে নাতারা হ্যাঁ, বলে তাদের মত প্রকাশ করল

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, এ ঘটনা ইসমাঈলের মাকে একটি সুযোগ এনে দিলআর তিনিও মানুষের সাহচর্য চেয়েছিলেন

অতঃপর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করল এবং তাদের পরিবার-পরিজনের নিকটও সংবাদ পাঠালতারপর তারাও এসে তাদেরও সাথে বসবাস করতে লাগল

পরিশেষে সেখানে তাদেরও কয়েকটি পরিবারের বসতি স্থাপিত হলআর ইসমাইলও যৌবনে উপনীত হলেন এবং তাদের থেকে আরবী ভাষা শিখলেন

যৌবনে পৌঁছে তিনি তাদের নিকট অধিক আকর্ষণীয় ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেনঅতঃপর যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করলেন, তখন তারা তাঁর সঙ্গে তাদেরই একটি মেয়েকে বিবাহ দিল

এরই মধ্যে ইসমাঈলের মা হাযেরা (আঃ) ইন্তিকাল করেনইসমাঈলের বিবাহের পর ইবরাহীম (আঃ) তাঁর পরিত্যক্ত পরিজনের অবস্থা দেখার জন্য এখানে আসলেন

 কিন্তু তিনি ইসমাঈলকে পেলেন নাতিনি তাঁর স্ত্রীকে তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেনস্ত্রী বলল, তিনি আমাদের জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে গেছেন

অতঃপর তিনি পুত্রবধূকে তাদের জীবন যাত্রা এবং অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেনসে বলল, আমরা অতি দূরবস্থায়, অতি টানাটানি ও খুব কষ্টে আছি
সে ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকট তাদের দুর্দশার অভিযোগ করলতিনি বললেন, তোমার স্বামী বাড়ী আসলে, তাকে আমার সালাম জানিয়ে বলবে, সে যেন তার ঘরের দরজার চৌকাঠ বদলিয়ে নেয়

অতঃপর যখন ইসমাঈল (আঃ) বাড়ী আসলেন, তখন তিনি যেন কিছুটা আভাস পেলেনতখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের নিকট কেউ কি এসেছিল? স্ত্রী বলল, হাঁএমন এমন আকৃতির একজন বৃদ্ধ লোক এসেছিলেন এবং আমাকে আপনার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলেন

আমি তাঁকে আপনার সংবাদ দিলামতিনি আমাকে আমাদের জীবন যাত্রা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাঁকে জানালাম, আমরা খুব কষ্ট ও অভাবে আছি

ইসমাঈল (‘আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি তোমাকে কোন নাসীহাত করেছেন? স্ত্রী বলল, হাঁতিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন আপনাকে তাঁর সালাম পৌঁছাই এবং তিনি আরো বলেছেন, আপনি যেন ঘরের দরজার চৌকাঠ বদলিয়ে ফেলেন

ইসমাঈল (‘আঃ) বললেন, ইনি আমার পিতাএ কথা দ্বারা তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, আমি যেন তোমাকে পৃথক করে দেইঅতএব তুমি তোমার আপন জনদের নিকট চলে যাওএ কথা বলে, ইসমাঈল (আঃ) তাকে তালাক দিয়ে দিলেন এবং ঐ লোকদের থেকে অন্য একটি মেয়েকে বিবাহ করলেন

অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) এদের থেকে দূরে রইলেন, আল্লাহ যতদিন চাইলেনঅতঃপর তিনি আবার এদের দেখতে আসলেনকিন্তু এবারও তিনি ইসমাঈল (আঃ)-এর দেখা পেলেন না

তিনি পুত্রবধূর নিকট উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেনসে বলল, তিনি আমাদের খাবারের খোঁজে বেরিয়ে গেছেন

ইবরাহীম (‘আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কেমন আছ? তিনি তাদের জীবন যাপন ও অবস্থা জানতে চাইলেনতখন সে বলল, আমরা ভাল এবং স্বচ্ছল অবস্থায় আছিআর সে আল্লাহর প্রশংসাও করল

ইবরাহীম (‘আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের প্রধান খাদ্য কী? সে বলল, গোশ্‌ততিনি আবার জানতে চাইলেন, তোমাদের পানীয় কী, সে বলল, পানিইবরাহীম (আঃ) দুআ করলেন, হে আল্লাহ্‌! তাদের গোশ্‌ত ও পানিতে বরকত দিন
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ঐ সময় তাদের সেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন হতো নাযদি হতো তাহলে ইবরাহীম (আঃ) সে বিষয়েও তাদের জন্য দুআ করতেন
বর্ণনাকারী বলেন, মক্কা ছাড়া অন্য কোথাও কেউ শুধু গোশ্‌ত ও পানি দ্বারা জীবন ধারণ করতে পারে নাকেননা, শুধু গোশ্‌ত ও পানি জীবন যাপনের অনুকূল হতে পারে না
ইবরাহীম (‘আঃ) বললেন, যখন তোমার স্বামী ফিরে আসবে, তখন তাঁকে সালাম বলবে, আর তাঁকে আমার পক্ষ থেকে হুকুম করবে যে, সে যেন তার ঘরের দরজার চৌকাঠ ঠিক রাখে
অতঃপর ইসমাঈল (আঃ) যখন ফিরে আসলেন, তখন তিনি বললেন, তোমাদের নিকট কেউ এসেছিলেন কি? সে বলল, হাঁএকজন সুন্দর চেহারার বৃদ্ধ লোক এসেছিলেন এবং সে তাঁর প্রশংসা করল, তিনি আমাকে আপনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেনআমি তাঁকে আপনার সংবাদ জানিয়েছি

অতঃপর তিনি আমার নিকট আমাদের জীবন যাপন সম্পর্কে জানতে চেয়েছেনআমি তাঁকে জানিয়েছি যে, আমরা ভাল আছিইসমাঈল (আঃ) বললেন, তিনি কি তোমাকে আর কোন কিছুর জন্য আদেশ করেছেন? সে বলল, হাঁতিনি আপনার প্রতি সালাম জানিয়ে আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি যেন আপনার ঘরের চৌকাঠ ঠিক রাখেন

ইসমাঈল (‘আঃ) বললেন, ইনিই আমার পিতাআর তুমি হলে আমার ঘরের দরজার চৌকাঠএ কথার দ্বারা তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, আমি যেন তোমাকে স্ত্রী হিসাবে বহাল রাখি

অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) এদের থেকে দূরে রইলেন, যদ্দিন আল্লাহ চাইলেনঅতঃপর তিনি আবার আসলেন। (দেখতে পেলেন) যমযম কূপের নিকটস্থ একটি বিরাট বৃক্ষের নীচে বসে ইসমাঈল (আঃ) তাঁর একটি তীর মেরামত করছেন

যখন তিনি তাঁর পিতাকে দেখতে পেলেন, তিনি দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেনঅতঃপর একজন বাপ-বেটার সঙ্গে, একজন বেটা-বাপের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে যেমন করে থাকে তাঁরা উভয়ে তাই করলেন

অতঃপর ইবরাহীম (আঃ) বললেন, হে ইসমাঈল! আল্লাহ্‌ আমাকে একটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেনইসমাঈল (আঃ) বললেন, আপনার রব! আপনাকে যা আদেশ করেছেন, তা করুনইবরাহীম (আঃ) বললেন, তুমি আমার সাহায্য করবে কি? ইসমাঈল (আঃ) বললেন, আমি আপনার সাহায্য করব

ইবরাহীম (‘আঃ) বললেন, আল্লাহ্‌ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাতে নির্দেশ দিয়েছেনএই বলে তিনি উঁচু ঢিলাটির দিকে ইশারা করলেন যে, এর চারপাশে ঘেরাও দিয়ে

তখনই তাঁরা উভয়ে কাবা ঘরের দেয়াল তুলতে লেগে গেলেনইসমাঈল (আঃ) পাথর আনতেন, আর ইবরাহীম (আঃ) নির্মাণ করতেন

পরিশেষে যখন দেয়াল উঁচু হয়ে গেল, তখন ইসমাঈল (আঃ) (মাকামে ইবরাহীম নামে খ্যাত) পাথরটি আনলেন এবং ইবরাহীম (আঃ)-এর জন্য তা যথাস্থানে রাখলেনইবরাহীম (‘আঃ) তার উপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ করতে লাগলেনআর ইসমাঈল (আঃ) তাঁকে পাথর যোগান দিতে থাকেন
তখন তারা উভয়ে এ দুআ করতে থাকলেন, হে আমাদের রব! আমাদের থেকে কবূল করুননিশ্চয়ই আপনি সব কিছু শুনেন ও জানেন

তাঁরা উভয়ে আবার কাবা ঘর তৈরী করতে থাকেন এবং কাবা ঘরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে এ দুআ করতে থাকেনহে আমাদের রব! আমাদের থেকে কবূল করে নিননিশ্চয়ই আপনি সব কিছু শুনেন ও জানেন। (আল-বাকারাহঃ ১২৭)








এই ছিল যমযম কূপের কাহিনী: কিন্তু দীর্ঘ দিন ব্যবহার  না থাকায় এবং বনু জুরহুম কতৃক যমযম কুপে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়ার ফলে কুপটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ৷ পরবর্তীতে রাসুল সা: এর দাদা  আব্দুল মুত্তালিব তা উদ্ধার করেন  এবার জেনে নেই হারিয়ে যাওয়া এই যমযম কূপ আব্দুল মুত্তালিব কিভাবে উদ্ধার করেছিলেন ৷

বনু জুরহুম গোত্রের আদি নিবাস ছিল ইয়ামানে ৷ সেখানে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়ায় বাধ্য হয়ে তারা ইয়ামান থেকে বের হয়ে আসে ৷ পথিমধ্যে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এবং তার মা হাজেরার সাথে জমজম কূপের নিকটে তাদের সাক্ষাত হলে জায়গাটি তাদের পছন্দ হয় ৷ এবং তারা সেখানে থাকতে শুরু করে ৷ পরবর্তী সময়ে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম তাদেরই এক মেয়েকে বিবাহ করেন ৷ অতঃপর আল্লাহ তা'আলা তাঁকে নবুওয়াত দান করেন এবং তিনি এই গোত্রসহ আমালিকা গোত্র এবং ইয়ামানেরর অধিবাসীদের জন্য নবী মনোনীত হন ৷ একশত ত্রিশ বছর বয়সে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের ইন্তেকাল হলে তার মায়ের কবরের পাশে কা'বা ঘরের হাতিম এর ভিতর -অংশে তাকে সমাহিত করা হয় ৷

হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর পর তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী পুত্র 'কায়দার' কাবাগৃহের মোতাওয়াল্লী ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৷ এভাবে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশে কাবাঘরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যাস্ত থাকে ৷ কালক্রমে বনু জুরহুম ও বনু ইসমাইলের মাঝে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়, তা থেকে ঝগড়া-বিবাদ তর্ক-বিতর্ক মারামারি পর্যায়ে এসে গেলে তাতে বনু জুরহুম জয়লাভ করে ৷ ফলে মক্কাবাসীদের উপর তাদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্বীকৃত এবং প্রতিষ্ঠিত হয় ৷ কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই বনু জুরহুমের শাসকগণ অত্যাচার ও নির্যাতন -নিপীড়ন চালাতে শুরু করে ৷ তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ বনু ইসমাইলের লোকজনের মক্কার মূল শহর এলাকা ত্যাগ করে শহরতলীতে চলে যাওয়া ব্যতিত কোন উপায় ছিল না ৷ পরবর্তী সময়ে তারা সেখানেই স্থায়ী হয়ে যায় ৷ বনু জুরহুমের অত্যাচার পাপাচার এবং কা'বা ঘরের অসম্মান ও মর্যাদা এত অধিক পরিমাণে হতে থাকে যে , আরবের সকল বংশ ও গোত্র একজোট হয়ে তাদের মুকাবেলায় দাঁড়িয়ে যায় ৷ ফলে বনু জুরহুমের লোকেরা পরাজিত অবস্থায় মক্কা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় ৷ তবে তারা পালানোর পূর্বে কাবা ঘরের ভেতরে সংরক্ষিত সকল সম্পদ জমজম কূপের ভিতরে ফেলে দিয়ে যায় ৷ তারা এতোটুকু করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং জমজম কূপের ভিতর মাটি ফেলে এমন ভাবে বন্ধ করে দেয় যে, তার আর কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট ছিল না ৷

বনু জুরহুম গোত্রের লোকেরা মক্কা ছেড়ে চলে গেলে ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর বংশীয় লোকেরা  আবার মক্কায় ফিরে আসে ৷ তারা স্বাভাবিক ভাবে থাকতে শুরু করলেও জমজম কূপের প্রতি তাদের কারো কোন লক্ষ্যই ছিল না ৷ ফলে একসময় তাদের থেকে জমজম কূপ একেবারে হারিয়ে গেল, তার আর কোন নাম -নিশানাও অবশিষ্ট রইল না ৷ পরবর্তী সময়ে যখন আব্দুল মুত্তালিবের হাতে নেতৃত্ব ও সরদারি ন্যস্ত হলো , তখন মহান আল্লাহ তা'আলা এই হারিয়ে যাওয়া কূপ পূনঃ প্রকাশের ইচ্ছা করলেন ৷ আব্দুল মুত্তালিব কে সত্য স্বপ্নের মাধ্যমে জমজমের সঠিক অবস্থান নির্দেশ করে সেমতে তা খনন করার আদেশ প্রদান করা হলো ৷ জায়গাটি যথাযথ শনাক্ত করার সুবিধার্থে স্বপ্নে বিভিন্ন নিদর্শনও বলে দেওয়া হল ৷ ফলে আব্দুল মুত্তালিবের সঠিক স্থানটি চিনে নিতে কোনো ভুল হলো না ৷

আব্দুল মুত্তালিব তার এ স্বপ্নের বর্ণনা প্রদান করে বলেন, আমি একদিন কা'বার হাতিমে ঘুমিয়ে ছিলাম ৷ তখন স্বপ্নে দেখলাম এক লোক এসে আমাকে বলল,'বাররাহ' খোদাই করো ৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাররাহ কি? লোকটি কোন জবাব না দিয়ে চলে গেল ৷ আমি পরদিন সেখানে পুনরায় ঘুমিয়ে থাকা কালে স্বপ্নে দেখা লোকটি আবার আমার কাছে এলো ৷ আজ সে এসে বলল 'মাযনুনাহ' খনন করো ৷ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মাযনুনাহ কি? লোকটি গতকালের ন্যায় কোন কথা না বলে চলে গেল পরদিন আবারও সেই স্থানে আমি ঘুমিয়ে রয়েছি লোকটি এসে আমাকে বলল 'তীবা' খনন করো ৷ আমি এবারও তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তীবা কি? লোকটি যথারীতি কিছু না বলে চলে গেল ৷ চতুর্থ দিন স্বপ্নে লোকটি পুনরায় এসে আমাকে বলল, যমযম খোদায় করো ৷ আমিও পূর্বের ন্যায় তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, যমযম কি? লোকটি বলল، لاتنزف ابدا ولاتذم تسقي الحجيج الاعظم
এটি এমন কূয়া যার পানি কখনো বন্ধ হবার নয়, হ্রাস পাবারও নয় ৷ অগণিত হাজীদেরকে এই কূপের পানি পান করানো হবে ৷ এরপর স্বপ্নে আগত সেই ব্যক্তি কিছু নিদর্শন ও চিহ্ন বলে দিলেন ৷ এভাবে বারবার স্বপ্ন দেখা এবং নিদর্শন ও চিহ্ন বলে দেওয়ায় আব্দুল মুত্তালিবের অন্তরে সত্য স্বপ্ন হওয়া সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসের সৃষ্টি হল ৷
আব্দুল মুত্তালিব কুরাইশের অন্য সকলের নিকট স্বপ্নের আলোচনা করলেন এবং সকলকে জানালেন, তিনি এই স্থান খনন করবেন ৷ শুনে সকলেই তার বিরোধিতা করল ৷ তিনি তাদের বিরোধিতার কিছুমাত্র পরোয়া না করে পুত্র হারেস কে সাথে নিয়ে কুদাল খুন্তি ইত্যাদিসহ স্বপ্নে দেখা নির্ধারিত স্থানে এসে পৌছলেন এবং নিদর্শন অনুযায়ী খনন করতে শুরু করলেন ৷ আবদুল মুত্তালিব খুঁড়তে লাগলেন এবং হারেস মাটি সরাতে লাগলেন ৷ এভাবে তিনদিন মাটি সরানোর পর কূপের সন্ধান পাওয়া গেল ৷ আব্দুল মুত্তালিব খুশিতে আত্মহারা হয়ে 'আল্লাহু আকবার' বলে চিৎকার করে উঠলেন ৷ বললেন, هذا طوى اسماعيل  এইতো ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর কুয়া ৷

আব্দুল মুত্তালিব জমজম কূপের নিকটে বেশ কিছু হাউজ নির্মাণ করে সেগুলোতে জমজমের পানি রাখার ব্যবস্থা করলেন ৷ তিনি সেসব হাউজ থেকে পানি উঠিয়ে হাজীদের পান করাতেন ৷ কিছু সংখ্যক হিংসুক তার সাথে শত্রুতাবশত শয়তানিতে মেতে উঠল ৷ তারা রাত্রিতে হাউজ নষ্ট করে ফেলত, আবদুল মুত্তালিব সকালে নিজ হাতে সেগুলো পরিষ্কার করতেন ৷ ক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে আব্দুল মোত্তালিব আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন ৷ তাকে স্বপ্নে বলা হলো, তুমি নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ঃ اللهم اني لا احلها لمغتسل ولكن هي لشارب 
হে আল্লাহ! আমি জমজমের এই পানি দ্বারা গোসল করার অনুমতি দেই না, কেবল পানি পান করার অনুমতি দেই ৷

সকালে ঘুম থেকে উঠে আব্দুল মুত্তালিব স্বপ্নে বলা এই নির্দেশ সকলকে শুনিয়ে দিলেন ৷ এরপর যে কেউ হাউজের পানি নষ্ট করার ইচ্ছা করেছে সেই কোন না কোন কঠোর ব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছে ৷ যখন বারবার এ ধরনের ইচ্ছায় রোগের আক্রমন হতে লাগল, তখন লোকজন জমজমের পানি নষ্ট করার মনোভাব ত্যাগ করল ৷


COMMENTS

3/random/post-list

Author Details

নাম

আকাবিরদের জীবন ও কর্ম,6,ই'তিকাফ,1,ইতিহাস,16,ইসলামি জীবন ব্যবস্থা,1,ঈমান -আকায়েদ,1,কুরবানী-আকীকা,3,জায়েয -নাজায়েয,2,তালাক,1,নামাজ,2,পবিত্রতা,1,পরকাল,3,প্রবন্ধ,4,ফাতাওয়া,22,ফাযায়েল - মাসায়েল,5,বিদয়াত-কুপ্রথা,1,বিবাহ -শাদী,1,বিবিধ,4,বিস্ময়কর ঘটনাবলি,10,ভ্রান্ত মতবাদ,1,যাকাত,1,রোযা,9,হজ্জ,1,হিকায়াতে সাহাবা,12,
ltr
item
ইসলামের আলো: যমযম কুপের বিস্ময়কর ইতিহাস: এবং আব্দুল মুত্তালিব কতৃক পুনঃরুদ্ধারের বিস্ময়কর কাহিনী
যমযম কুপের বিস্ময়কর ইতিহাস: এবং আব্দুল মুত্তালিব কতৃক পুনঃরুদ্ধারের বিস্ময়কর কাহিনী
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjtv8CQAmwVfSNnVoc3H-zrg_RRTok7pfe1vxuYE3YubfLKKH8hc3ZEg2O_BjPysPeGbo5CODXmjV8_zkU4R0MA81SZrCPi1stXY0J8zpBoM6Y1YczAmRjUUBweuOg_w-EsUP6VtJd9hNlE/s320/PicsArt_02-27-09.25.54.jpg
https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjtv8CQAmwVfSNnVoc3H-zrg_RRTok7pfe1vxuYE3YubfLKKH8hc3ZEg2O_BjPysPeGbo5CODXmjV8_zkU4R0MA81SZrCPi1stXY0J8zpBoM6Y1YczAmRjUUBweuOg_w-EsUP6VtJd9hNlE/s72-c/PicsArt_02-27-09.25.54.jpg
ইসলামের আলো
https://islamickolam.blogspot.com/2019/06/blog-post_22.html
https://islamickolam.blogspot.com/
https://islamickolam.blogspot.com/
https://islamickolam.blogspot.com/2019/06/blog-post_22.html
true
2611355369920375554
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share. STEP 2: Click the link you shared to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy